টিভি ও মঞ্চ নাটকের তুখোড় একজন অভিনেতা ছিলেন আব্দুল কাদের। বহু নাটকে তিনি দর্শক হাসিয়েছেন। কাজ করেছেন ‘রং নাম্বার’ ও ‘ভালোবাসা জিন্দাবাদ’ নামে দুটি সিনেমায়ও। অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন টেনাশিনাস পুরস্কার, মহানগরী সংস্কৃত গোষ্ঠী পুরস্কার, জাদুকর পিসি সরকার পুরস্কার ও টেলিভিশন শ্রোতা ফোরাম পুরস্কার। দেশের তুমুল জনপ্রিয় টিভি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র নিয়মিত একজন শিল্পী ছিলেন। পাশাপাশি কাজ করতেন একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে।
গুণী এই মানুষটিকে হারানোর তিন বছর হয়ে গেল। ২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৮টার দিকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন আব্দুল কাদের। তিনি মরণব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন, যেটা চতুর্থ স্টেজে ছিল। পাশাপাশি করোনায়ও আক্রান্ত হয়েছিলেন প্রয়াত এই অভিনেতা। ভর্তি ছিলেন করোনা ইউনিটে। ২৪ ডিসেম্বর রাত ১২টার দিকে হঠাৎই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। পরে করোনা ইউনিট থেকে তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। ২৬ ডিসেম্বর সেখানেই তিনি মারা যান।
এদিকে অভিনেতা আব্দুল কাদেরর মৃত্যুবার্ষিকীতে বেশ স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছেন নাতনী সিমরান লুবাবা। এই শিশু শিল্পী তার ফেবুকে লিখেন, ডিসেম্বর মানেই আমাদের জীবনে আনন্দ বেদনার স্মৃতি ফিরে আসা। ২০২০ সালের আগ পযর্ন্ত ডিসেম্বর ছিলো আমাদের পরিবারের কাছে শুধুই আনন্দের উপলক্ষ্য। কারণ, ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে এদেশের বীর যোদ্ধারা আমাদের জন্য স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীন একটি দেশ। প্রতিবছর ১৬ই ডিসেম্বর আমরা বিজয় দিবস উদযাপন করতাম। ২০২০ সালের আগ পযর্ন্ত প্রতি বছর সেই উদযাপনে আমার পুরো পরিবার একসাথে থাকতো। আমাদের মধ্যমণি হতেন আমার দাদা ভাই। তারপর এক ঝড়ে সব এলোমেলো হয়ে গেলো। সেই ঝড়ের পর থেকে প্রতি বছর ডিসেম্বর আসে আমাদের জীবনে আনন্দ আর বেদনা নিয়ে। বিজয় দিবস মানেই আমাদের আনন্দ আর বিজয় দিবসের ঠিক দশদিন পর ২৬ ডিসেম্বর আমাদের জন্য অত্যন্ত বেদনার। ২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছিলাম আমাদের পরিবারের সবচেয়ে আলোকিত মানুষ,,সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মানুষ,সবচেয়ে প্রিয় মানুষ, আমার দাদা শ্রদ্ধেয় আব্দুল কাদের কে। আজ আরও একটি ২৬ ডিসেম্বর চলে যাচ্ছে।
তিন বছর আগে আজকের এই দিনে আমার দাদা ভাই সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলেন। আমার দাদা ভাই কেমন মানুষ ছিলেন তা আপনাদের অনেকেই জানেন। অভিনয় জীবনে তিনি নানা চরিত্রে অভিনয় করে সবাইকে হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন, আনন্দ দিয়েছেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন নিরেট সাদা মনের মানুষ। ঠিক যেমন ইত্যাদিতে মামা ভাগ্নে চরিত্রে নিরেট ভালোমানুষ মামাকে দেখা যেতো সেরকম। তিনি সব সময় সবার সাথে ভালো আচরণ করতেন। তিনি তার মৃত্যুর পরও আজও সবার কাছে নানা ভাবে সমাদৃত হয়ে থাকেন। পারিবারিক ভাবে সেটা আমাদেরকে আনন্দ দেয়। আজ দাদার মৃত্যুবার্ষিকীতে আপনাদের কাছে আমার দাদা ভাইয়ের জন্য দোয়া চাই। আমার দাদার জন্য আপনারা দোয়া করবেন।
আমার বিশ্বাস আপনাদের মধ্যে অনেকেই দাদাকে খুব পছন্দ করতেন। পছন্দের মানুষের জন্য দোয়া করলে আল্লাহ সেই দোয়া ইনশা আল্লাহ কবুল করবেন বলে আশা করি। আমার জন্যও দোয়া করবেন আর আমার মায়ের জন্যও দোয়া করবেন। আম্মুর শরীরটা হঠাৎ করে বেশ খারাপ হয়ে গেছে। আজকে দাদার মৃত্যুবার্ষিকীতে আম্মু সুস্থ্য থাকলে নিজে তত্ত্বাবধায়ন করে সব কিছু করতেন। দোয়ার আয়োজন থেকে শুরু করে সব কিছু তিনি সামলে নিতেন। আজকের দিনে অসুস্থ হয়ে তিনি বিছানায় থেকে যতটা পারছেন নির্দেশনা দিয়েছেন। তার অনেক কষ্ট হচ্ছে যে তিনি দাদার মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে নিজে দেখাশোনা করে সব কিছু করতে পারছেন না।
আমি জানি আপনাদের অনেকেই আমাকে ভালোবাসেন,স্নেহ করেন। ভালোবাসেন আর স্নেহ করেন বলেই নানা সময়ে আমার ভুল হলে সেগুলো নিয়ে সমালোচনা করেন এবং আমাকে শুধরে দিতে চেষ্টা করেন। সে জন্য আমি অবশ্যই আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আপনাদের কাছে আমি ঋণী। প্রতিনিয়ত আমাকে আপনারা যেভাবে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। আমাদের খুব ইচ্ছে আছে দাদার স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি স্বারক গ্রন্থ প্রকাশ করার। আমরা জানিনা কার সাথে দাদার কেমন স্মৃতি আছে। জানিনা দাদাকে নিয়ে আপনাদের কার কী লেখার আছে। আপনারা যারা সরাসরি দাদার সাথে পরিচিত ছিলেন এবং তার সাথে আপনাদের স্মৃতি আছে আমরা চাই আপনারা আমার দাদার সাথে থাকা সেই সব স্মৃতিকথা লিখুন। এবং যাদের সাথে দাদার পরিচয় না থাকলেও দাদাকে ভালোবাসতেন পছন্দ করতেন তারাও দাদাকে নিয়ে লিখতে পারেন। আমরা সেই সব লেখা একত্র করে একটি স্বারক গ্রন্থ প্রকাশ করতে চাই। যাদের লেখা সেই গ্রন্থে স্থান পাবে তাদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করে গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচনের আয়োজনও করতে চাই।
আমার দাদা প্রয়াত আব্দুল কাদের ভাষা আন্দোলনের আগের বছর ১৯৫১ সালে ১লা এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তানের মুন্সীগঞ্জ জেলার টংগিবাড়ী উপজেলার সোনারং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।তার পিতার নাম ছিলো আবদুল জলিল এবং মাতার নাম ছিলো আনোয়ারা খাতুন।
তিনি সোনারং হাইস্কুল ও বন্দর হাইস্কুল থেকে এস.এস.সি, ঢাকা কলেজ থেকে এইচ.এস.সি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বিএ অনার্স ও এমএ করেছিলেন। আমার দাদা যেখানেই থাকুক আল্লাহ যেন তাকে ভালো রাখেন,তার জীবনের সব গোনাহ মাফ করে দেন এবং তাকে জান্নাত দান করেন। আমি দাদাকে খুব মিস করি। যদি দাদা আরও দশ বছর বেঁচে থাকতেন তবে হয়তো আমি তার থেকে আরও অনেক কিছু শিখতে ও জানতে পারতাম।